বিশ্বব্যাপী তামাক কোম্পানিগুলো তামাক করের প্রভাবকে দুর্বল করার জন্য তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণে বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করছে।  একইসঙ্গে মানুষ যাতে ধূমপান অব্যাহত রাখে সেজন্য তারা সিগারেটের দামে হেরফের করছে। বাংলাদেশ, মেক্সিকো, পাকিস্তান, তুরস্ক এবং যুক্তরাজ্যসহ সম্প্রতি তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করেছে এমন প্রায় ৩০টি দেশের তথ্য নিয়ে “The Price We Pay: Six Industry Pricing Strategies That Undermine Life-Saving Tobacco Taxes” শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করেছে তামাক কোম্পানি পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘স্টপ’।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তামাক কোম্পানির কৌশলগুলো নিয়ে প্রকাশিত গবেষণাগুলো একত্রিত করে এবং ধনী দেশগুলোর কৌশলগুলির সাথে তাদের তুলনা করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনের বলা হয়েছে, স্টপের প্রতিবেদনে কীভাবে তামাক কোম্পানিগুলো সিগারেটের দাম নিয়ন্ত্রণ ও হেরফের করে তা স্পষ্ট হয়েছে।  এতে দাম নিয়ে কোম্পানি কর্তৃক ৬টি উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে,

ডিফারেনশিয়াল শিফটিং : বিশ্বব্যাপী তামাক কোম্পানিগুলো সিগারেটের মূল্য প্রভাবিত করতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে ডিফারেনশিয়াল শিফটিং পদ্ধতি।  এক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোতে ওভার শিফটিংয়ের মাধ্যমে কর হার বৃদ্ধির তুলনায় সিগারেটের মূল্য বাড়িয়ে দেয়।  এর ফলে সাধারণত ভোক্তারা করভার বহন করে। বিপরীতে তামাক কোম্পানিগুলো আরও অধিক মুনাফা লাভ করে।

অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সাধারণত আন্ডার শিফটিং পদ্ধতিতে সিগারেটের মূল্য প্রভাবিত করে থাকে তামাক কোম্পানিগুলো।  যেহেতু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত যে, তামাকজাত দ্রব্যের দাম বাড়লে ধূমপায়ীদের সংখ্যা কমে এবং ধূমপান ছাড়তে উৎসাহিত হয়।  ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ভোক্তাদের ওপর পুরোটা না দিয়ে তামাক কোম্পানিও আরোপকৃত কর হারের কিছু অংশ বহন করে। অবশ্য গবেষণায় দেখা গেছে, কখনও কখনো তামাক কোম্পানিগুলো একই দেশে উভয় কৌশলই অনুসরণ করে।  একইসঙ্গে অতি উচ্চস্তরের সিগারেটের দাম এবং বাজেটে সিগারেটের একাধিক স্তরের মধ্যে দামের ব্যবধান বাড়িয়ে দেয়।

নতুন ব্র্যান্ড প্রবর্তন : মূল্যে প্রভাব ফেলতে তামাক কোম্পানির আরেকটি কূটকৌশল হলো দাম কম রাখতে সস্তা ব্র্যান্ডের মতো, ভেরিয়েন্ট, সেগমেন্টের সিগারেটের প্রবর্তন করা। যা তামাক কোম্পানিগুলোর কাছে বিশ্বব্যাপী অনেক জনপ্রিয় কৌশল।

মূল্য বৈষম্য : এ ধরনের পদ্ধতিতে তামাক কোম্পানিগুলো একই পণ্য বিভিন্ন মূল্যে বিভিন্ন গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করে।  একইসঙ্গে নিজেদের পণ্যের প্রমোশন করে।

দাম বৃদ্ধি বুঝতে না দেয়া : বাজেটে কর বৃদ্ধি করলেও সময়ের সাথে সাথে এমনভাবে ধীরে ধীরে দাম বাড়াতে হবে যাতে ভোক্তাদের লক্ষ্য করার সম্ভাবনা কম থাকে। ফলে তারা তামাক সেবন কমানো বা বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিবে না।

সংকোচন অবলম্বন করা : মূল্যে প্রভাব ফেলার আরেকটি জনপ্রিয় কৌশল হলো একাধিক প্যাকেটে শলাকার কমবেশি করে বাজারজাত করা।  যেমন : একটি প্যাকেটে সিগারেটের সংখ্যা কমিয়ে বা তাদের আকার কমিয়ে দাম বৃদ্ধি করলে ভোক্তারা এক সাথে অধিক শলাকার প্যাকেট না কিনে কম শলাকার প্যাকেট কিনবে। এতে দাম বৃদ্ধির প্রভাব ভোক্তারা সংকোচন মনে করবে।

পণ্যের বৈশিষ্ট্য বা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন : সিগারেট বা তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করা হলে সেটা যাতে  ভোক্তাদের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে না পারে সেজন্য তামাকজাত দ্রব্যের বৈশিষ্ট্য বা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন নিয়ে আসে তামাক কোম্পানি।  যেমন অনেক দেশে সিগারেটের মতো সিগারিলো’র প্রবর্তন করা। কারণ অনেক দেশে এগুলোতে কম হারে ট্যাক্স আরোপ করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তামাক কর তামাক ব্যবহার কমানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।  কিন্তু এটি শুধুমাত্র তখনই কাজ করে যখন ভোক্তারা উচ্চ মূল্যের প্রভাব অনুভব করেন।  অনেক সময় তামাক কোম্পানিগুলো দাম কম রেখে এবং বাজারের শেয়ার ধরে রেখে কর বৃদ্ধির কৌশলটিকে বাঞ্চাল করতে পারে।  যেমন অনুমান করা হয় যে সাধারণত ধনী দেশগুলির তুলনায় বিশ্বের ৮০ শতাংশ ধূমপায়ী বিশ্বের দক্ষিণের দেশগুলোতে রয়েছে যেখানে অতিউচ্চ স্তর এবং নিম্ন স্তরের সিগারেটের মধ্যে ব্যবধান অনেক বেশি।

যেমন আফ্রিকা মহাদেশে সিগারেটের ভোক্তা বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করছে তামাক কোম্পানিগুলো। এখানে তুলনামূলকভাবে নিম্ন স্তরের সিগারেটের দাম বিশ্বে সবচেয়ে সস্তা।

এ প্রতিবেদনের সহলেখক ইউনিভার্সিটি অফ বাথ স্কুল অফ ম্যানেজমেন্টের ব্যবসায়িক অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক ও তামাক নিয়ন্ত্রণ গবেষণাকারী দলের অন্যতম সদস্য ড. রব ব্রান্সটন বলেন, তামাক কোম্পানি কীভাবে মানুষের আসক্তি এবং তামাকজাত দ্রব্যের মূল্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে স্টপ এই প্রতিবেদনে সেটার বিস্তারিত তুলে ধরেছে।

তিনি আরও বলেন, তামাক কোম্পানিগুলো কর ব্যবস্থার জটিলতাকে কীভাবে কাজে লাগায় সেটা এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হিসেবে উঠে এসেছে।  আসলে উচ্চ তামাক কর এবং মূল্য প্রয়োগ করে রাজস্বের পাশাপাশি স্বাস্থ্য সুবিধার বিষয়টি বিবেচনা করা হয়।  এজন্য তামাক পণ্যের স্তরগুলিতে ধারাবাহিকভাবে দাম ও কর হার বৃদ্ধি এবং এক শলাকার সিগারেট বাজার থেকে অপসারণ করা হয়।

বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, কলম্বিয়া এবং বতসোয়ানা, জাম্বিয়া, মোজাম্বিক এবং ইথিওপিয়াসহ প্রতিবেদনে উল্লিখিত বেশ কয়েকটি আফ্রিকান দেশে, এক শলাকা সিগারেটের প্রাপ্যতা বাজারকে জটিল করে তুলেছে।  এক শলাকাগুলো কোম্পানিদের মূল্য নির্ধারণের দ্বিতীয় কৌশল প্রয়োগ করার সুযোগ দেয়, যা সিগারেটের প্যাকেটে উল্লিখিত দামের চেয়ে আলাদা হতে পারে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এক শলাকা বিক্রির হলে কর বৃদ্ধির প্রভাব তুলনামূলক কম হয়। একইসঙ্গে ভোক্তাদের সস্তা সিগারেট সেবন করতে এবং ধূমপানের অভ্যাস বজায় রাখতে সাহায্য করে।  বিপরীতে প্যাকেটের দাম বৃদ্ধি পেলে তামাক সেবন ছেড়ে দেওয়ার পরিবর্তে ভোক্তাদের এক শলাকা ক্রয় করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

সরকার কোম্পানির কারসাজি যেভাবে প্রতিরোধ করতে পারে

স্টপ এই প্রতিবেদন মূল্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা তামাক কোম্পানিগুলোর ব্যাপারে কিছু পদক্ষেপ সুপারিশ করে।  এর মধ্যে রয়েছে:

১. প্রচারমূলক মূল্য হ্রাস নিষিদ্ধ করা;

২. দাম মসৃণতা মোকাবেলা করার জন্য শিল্প কতবার তাদের দাম পরিবর্তন করতে পারে তা সীমিত করা;

৩. দামের সংকোচন রোধ করার জন্য তামাকের প্যাকেটের আকার নির্দিষ্ট করা;

৪. একই পণ্যগুলোর মধ্যে করের হার সমান করা এবং তামাক কোম্পানিগুলোর ব্র্যান্ডের সংখ্যা সীমিত করা যাতে ভোক্তাদের সস্তা ব্র্যান্ডগুলিতে সুইচ করা রোধ করতে পারে;

৫. বড়ো ধরণের কর হার প্রবর্তন করা যাতে তামাক কোম্পানি নয়, সরকার উচ্চ মূল্যের সুবিধা পায়;

৬. এক শলাকা বিক্রি বন্ধ করা, যা যুবক এবং অন্যান্য ব্যয়-সচেতন গোষ্ঠীর কাছে তামাককে সহজলভ্য করে তোলে।

৭. কোম্পানিগুলোর প্রভাব দূর করতে সরাসরি তামাকের দাম নির্ধারণের কথা বিবেচনা করা।

প্রতিবেদনের শেষে বাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তামাক নিয়ন্ত্রণ গবেষণা গ্রুপের সহলেখক ড. জয়েনব শেখ বলেছেন, সিগারেট কোম্পানির উদ্দেশ্য হলো তাদের বাজারের অংশীদারিত্ব বজায় রাখার সাথে তাদের আয় বৃদ্ধির ভারসাম্য বজায় রাখা।  সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তরুণদের সংখ্যা ধরে রেখে তাদের মুনাফা অর্জন করা। তারা খুব কমই জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনা করে। আর ঠিক এ জন্যই জনগণের স্বার্থে সরকারের এগিয়ে থাকা উচিত।

 

To read Stop’s report, please click here.

23 February, 2023