Work for better Bangladesh Trust published this publication on Prevention of Tobacco Tax Evasion: “Law and Policy Review”. Please read the full publication in Bengali.
তামাকজাত দ্রব্যের কর ফাঁকি রোধ
“আইন ও নীতি পর্যালোচনা”
তামাকের কর বাড়ানোর বিষয়টি উত্থাপিত হলেই তামাক কোম্পানীগুলো চোরাচালান এবং কর ফাঁকির বিষয় সামনে এনে কর বৃদ্ধির বিরোধীতা করে। অথচ, কর বৃদ্ধির সাথে চোরাচালান এবং কর ফাঁকির কোন যোগসুত্র নেই। এটি মূলত তামাক কোম্পানী কর্তৃক জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (ঘইজ) সহ নীতিনির্ধারকদের বিভ্রান্ত করার কৌশল মাত্র। অনেক ক্ষেত্রেই তামাক কোম্পানিগুলোর নিজস্ব ব্যবসায়িক স্বার্থে এ কাজের সাথে জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী। শুল্ক বৃদ্ধি না করে তামাকের মতো অস্বাস্থ্যকর পণ্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় এবং কর বৃদ্ধিই তামাক নিয়ন্ত্রণের সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হিসাবে বিবেচিত ।
তামাক উৎপাদন ও ব্যবসায়ের সাথে জড়িতরা দাবি করেন যে, দাম ও কর বাড়ার ফলে বাজারে চোরাচালান এবং অবৈধ বাণিজ্যের বিস্তার ঘটবে এবং সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার আশংকা বৃদ্ধি পাবে। ব্রাজিল, তুরস্ক, এবং কেনিয়াসহ বিশে^র অনেক দেশ এ সমস্যা সমাধানে সরবরাহ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে উন্নত ও ডিজিটালাইজড ট্যাক্স ট্র্যাকিং এবং ট্রেসিং সিস্টেম গ্রহণ করেছে । ফলে, তামাকজাত পণ্যের উচ্চমূল্য সত্ত্বেও এসব দেশে অবৈধ বাণিজ্য এবং তামাকের ব্যবহার হ্রাসের পাশাপাশি তামাক খাত থেকে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেয়েছে । এই পলিসি পেপারের মাধ্যমে বাংলাদেশে উল্লেখিত সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়েছে।
তামাক করের প্রচলিত আইন ও বর্তমান পরিস্থিতি: বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩৫.৩% প্রাপ্তবয়স্ক সিগারেট, বিড়ি, গুল, জর্দ্দা ও অন্যান্য তামাকজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করে । ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যার দিক দিয়ে নারী ও পুরুষ উভয়েই প্রায় সমান (মহিলা ২৪.৮%, পুরুষ ১৬.২%) । মোট জনসংখ্যার এতো বৃহৎ একটি অংশ এই ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য গ্রহন করা সত্ত্বেও উক্ত খাত থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রাপ্ত রাজস্ব মাত্র ৩১.৯৯ কোটি টাকা যা মোট তামাক খাত থেকে প্রাপ্ত মোট রাজস্বের মাত্র ০.১২% ।
বাংলাদেশ সরকার প্রতিবছর জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধি করে, যা খুবই সামান্য। বিশেষজ্ঞদের মতে এটি তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য মোটেও যথেষ্ট নয়। বর্তমানে তামাকজাত দ্রব্যের উপর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আরোপিত শুল্ক পদ্ধতিটি এ্যাড ভ্যালোরেম নামে পরিচিত এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতা বলে সিগারেটের কর ব্যবস্থা চারটি স্তরে বিভক্ত। গবেষণায় দেখা যায়, এ পদ্ধতিটি ত্রুটিপূর্ণ এবং প্রচলিত মূল্যস্তরের কারণে কর আদায়ের এই পদ্ধতিটি আরো জটিল হয়ে গেছে। মূল্যস্তরের এই ভিন্নতার পাশাপাশি সম্পুরক শুল্কের ক্ষেত্রেও রয়েছে ভিন্নতা।
বাংলাদেশের মোট সিগারেট খাতের ৭১.৩৮% বাজার দখল করে আছে নিম্ন মূল্যস্তরের সিগারেট । যার ভোক্তা নিম্ন আয়ের মানুষ। নিম্নস্তরের সিগারেটে ৫৭% এবং মাঝারি, উচ্চ ও প্রিমিয়াম স্তরের সিগারেটের উপর ৬৫% সম্পূরক শুল্ক বিদ্যমান রয়েছে । খাদ্য, ঔষধ, চিকিৎসাসহ সকল নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম প্রতিবছর লাফিয়ে বাড়লেও, দরিদ্র জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হবে এই অজুহাতে নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম বৃদ্ধি করা হচ্ছে না।
স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এই দ্রব্য বছরের পর বছর মানুষের হাতের নাগলে রাখা হচ্ছে দরিদ্র শ্রেণীর কথা মাথায় রেখে নয় বরং কোম্পানির অধিক লাভের স্বার্থেই। বিদ্যমান মূল্য সংযোজন কর আইন অনুসারে তামাকজাত দ্রব্যের উপর সুনির্দিষ্ট কর আরোপ ও কর আদায় পদ্ধতিটি আধুনিকায়নের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব ।
ব্যান্ডরোল বাংলাদেশের তামাকজাত দ্রব্যের কর আদায়ের অন্যতম প্রধান মাধ্যম । বিড়ি ও সিগারেটের ক্ষেত্রে উক্ত ব্যান্ডরোল আলাদা আলাদাভাবে ব্যবহৃত হয় । বিড়ির প্যাকেটে ব্যবহৃত ব্যান্ডেরোলটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে একটি নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করে সংগ্রহ করতে হয় এবং সিগারেট কোম্পানীগুলোকে চালানের মাধ্যমে এই ব্যান্ডরোল সরবরাহ করা হয় । সিগারেট কোম্পানীগুলো পরবর্তীতে এই মূল্য পরিশোধ করে থাকে। বর্তমানে ব্যবহৃত ব্যান্ডরোলগুলো দেখে আসল নকল যাচাই করা খুবই কঠিন। পাশাপাশি মনিটরিং ব্যবস্থা দূর্বল থাকায় অনেক ক্ষেত্রে নকল ব্যান্ডরোল ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে। এ সমস্যা সমাধানে ব্যান্ডরোল আধুনিকায়নে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
তামাক কোম্পানির মিথ্যাচার: স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর দ্রব্য হওয়া সত্বেও তামাক শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তামাকের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে এর ক্ষতিকারক দিকগুলো আড়াল করার চেষ্টা করে। তামাক নিয়ন্ত্রণে সহায়ক নীতি প্রণয়ন প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হলেই কোম্পানিগুলো প্রধানত, রাজস্ব ক্ষতি, চোরাচালান ও কর্মসংস্থানের যুক্তি দেখিয়ে সেটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করে । বছরজুড়ে তামাকজাত দ্রব্য চোরাচালানের তেমন কোনো খবর চোখে না পড়লেও, ঠিক বাজেট ঘোষনার কিছুদিন আগে থেকে এই জাতীয় তথ্য নিয়মিত খবরের পাতায় প্রকাশ পায়। এই বিষয়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ গবেষক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সুশান্ত সিনহার এক গবেষণা থেকে জানা যায় যে, এই সময়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের মধ্যে শতকরা ২১% খবর নীতি নির্ধারক ও জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করতে প্রচার করা হয় ।
বাংলাদেশ সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুসারে, কর ও মূল্য বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশে সিগারেট চোরাচালান বেড়ে যাবে । কিন্তু, মাত্র ২-৩ টি দেশ ব্যাতিরেকে পৃথিবীর অন্যান্য সকল দেশের সিগারেটের দাম বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি । তাছাড়া, একাধিক গবেষণায় পাওয়া যায় যে, বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি হওয়া অবৈধ ও নকল সিগারেট/বিড়ি মোট উৎপাদিত সিগারেট/বিড়ির প্রায় ২ শতাংশ যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় খুবই নগন্য । সুতরাং, সিগারেট চোরাচালানের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং এটি তামাক কোম্পানি কর্তৃক প্রচারিত একটি কল্প কাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়।
বেশ কয়েকটি দেশ থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কেবল বাংলাদেশেই নয় বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেমন- ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশেও ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে । তামাক কোম্পানি কর্তৃক আরেকটি প্রচলিত মিথ হলো, তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদন, চাষ, বিতরণ ও বিক্রয় বন্ধ করলে জাতীয় অর্থনীতি একটি বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে এবং অনেক মানুষ তাদের চাকরি হারাবে। অথচ, তামাক কোম্পানির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত কর্মীর সংখ্যা তামাক কোম্পানি কর্তৃক প্রচারিত সংখ্যার তুলনায় অনেক কম ।
বিড়ি কারখানার মালিকরা দীর্ঘদিন ধরে কয়েক লক্ষ শ্রমিকের মিথ্যা দাবি করে থাকলেও, বিভিন্ন গবেষণা ও একাধিক জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে দেখা যায়, প্রকৃতপক্ষে বিড়ি কারখানায় কাজ করছে ৬৫ হাজারেরও কম শ্রমিক । প্রত্যেকটি বিড়ি কারখানায় কর্মরত শিশুর সংখ্যাও অনেক। যদিও আইন অনুযায়ী বিড়ি শিল্পে শিশুশ্রম ব্যবহার নিষিদ্ধ। অপরদিকে প্রতিবছর সিগারেট কোম্পানিতে আধুনিক মেশিন সংযোজন হওয়া ও শ্রমিকদের সম্পৃক্ত করার সংখ্যা দিন দিন কমে
আসছে। এ সকল নানা বির্তকের মাধ্যমে কোম্পানিগুলো প্রতি বছর তামাক খাত থেকে সরকারের উপার্জিত রাজস্বের তুলনায় তামাকজনিত চিকিৎসা বাবদ সরকারের অধিক ব্যয় হওয়ার বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যায় ।
তামাকজাত দ্রব্যের কর আদায়ের অন্যতম মাধ্যম “ব্যান্ডরোল” এখনো যুগোপযোগী নয়। যার ফলে দেশে উৎপাদিত তামাকজাত পণ্য সম্পর্কে সঠিকভাবে তথ্য সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না। কর আদায় সম্পর্কিত তথ্য সংরক্ষনের স্বার্থেই এর আধুনিকায়ন জরুরী। তামাক কোম্পানীগুলো কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য ৩টি পৃথক অসৎ উপায় অবলম্বন করে থাকে। পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে নীচে উল্লেখ এবং বর্ণনা করা হলো:
১. নকল ব্যান্ডরোল: বাংলাদেশে তামাক কর ফাঁকি দেওয়ার অন্যতম মাধ্যম হল নকল ব্যান্ডেরোল ব্যবহার। জাতীয় কর আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশে উৎপাদিত তামাক পণ্যের মোড়কে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে কেনা ট্যাক্স স্ট্যাম্প যুক্ত করা বাধ্যতামূলক। প্যাকেটে জাল প্রিন্টেড ব্যান্ডেরোল ব্যবহার করার একাধিক প্রমাণ রয়েছে, যা আমরা বিভিন্ন গনমাধ্যম থেকে জানতে পারি ।
২. ব্যান্ডরোলের পুনঃ ব্যবহার: বাংলাদেশের ভ্যাট আইন অনুসারে, প্রতিটি সিগারেট ও বিড়ির প্যাকেটে সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস কর্পোরেশন লিমিটেড দ্বারা সরবরাহকৃত একটি নতুন ব্যান্ডরোল ব্যবহার করতে হয়। বিভিন্ন তামাক কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবহৃত ব্যান্ডেরোল পুনরায় ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে যার মূল উদ্দেশ্য সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেয়া ।
৩. ব্যান্ডরোল ব্যবহার না করা: বিড়ি ও সিগারেটের প্যাকেটে বাধ্যতামূলক ব্যবহার্য ব্যান্ডেরোল ছাড়াই তামাকজাত পণ্য বিপণন করে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হাতিয়ে নিচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো । তাছাড়া, এই জনস্বাস্থ্যহানীকর পণ্যটি বিপণনের জন্য কোম্পানী খুচরা বিক্রেতাদের বিভিন্ন লোভনীয় উপহার প্রদান করছে । এই কারণে, দোকানদাররাও আসল নকলের বিচার বিবেচনা না করেই এসব অবৈধ বিড়ি ও সিগারেট বিক্রি করছেন।
এ সকল সমস্যা সমাধানে তামাকজাত দ্রব্যের কর আদায়ের প্রচলিত পদ্ধতির পরিবর্তে ডিজিটালাইজড ট্র্যাকিং, ট্রেসিং ও মনিটরিং পদ্ধতি সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী যে পদ্ধতিগুলো বহুল প্রচলিত তন্মধ্যে ডিজিটালাইজড ব্যান্ডরোল/ট্যাক্স স্ট্যাম্প, বারকোড, হলোগ্রাম, স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং, অনলাইন অভিযোগ দাখিল অন্যতম। বাংলাদেশে কর আদায়ে সরকারের পদক্ষেপ, বর্তমান প্রেক্ষাপট, তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের সদিচ্ছা, রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, নির্ভুল তথ্য উপাত্ত যাচাই ও ডিজিটালাইজেশনের উন্নতি বিবেচনায় এই সকল নতুন বিধান যুক্ত করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন ২০১২ এর ধারা ৫৮ তে সুস্পষ্ট ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে । এ বিধান অনুযায়ী তামাক কর আদায়ে প্রচলিত নিয়মের ত্রুটিগুলো সংশোধন করা সম্ভব। তবে এই সকল পদ্ধতির মধ্যে বারকোডের ব্যবহার সর্বাধিক সঠিক তথ্য প্রদান করতে সক্ষম। বিভিন্ন দেশে তামাক কর আদায়ের প্রচলিত পদ্ধতি এবং এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশে যে সকল পদ্ধতি অবলম্বন করা সম্ভব সে সম্বন্ধে কিছু তথ্য ও ব্যবহারবিধি নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
বারকোড: একাধিক বাজার গবেষণা করে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে উৎপাদিত প্রায় সকল সিগারেটের প্যাকেটে বারকোড ব্যবহার করা হচ্ছে, অর্থাৎ বাংলাদেশে এ প্রযুক্তি নতুন নয়। দেশে তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেটে স্ট্যাম্প/ব্যান্ডরোলের মাধ্যমে কর আদায় নিশ্চিত করা হয়। তবে স্ট্যাম্প ও ব্যান্ডরোলটি সঠিক কিনা তা শুধুমাত্র বিশেষ কিছু ব্যক্তি জটিল প্রক্রিয়া অনুসরণ করে চিহ্নিত করতে পারে । মনিটরিং ব্যবস্থার দূর্বলতা এবং স্ট্যাম্প/ব্যান্ডরোল আসল নকল চিহ্নিত করা জটিল হওয়ার সুবাদে অসাধু ব্যবসায়ীরা সহজেই কর ফাঁকি দিতে পারে। এক্ষেত্রে ব্যান্ডরোলের উপর বারকোড ব্যবহার করা গেলে তা হতে পারে একটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। এতে একটি বিশেষ সিরিয়াল থাকে যার মাধ্যমে শুল্ক প্রদানের তথ্যসহ উৎপাদনের তারিখ, পণ্যের ধরন, গ্রাহকের নাম, সরবরাহের ঠিকানা সনাক্ত করা সম্ভব । প্রয়োজনে এই বারকোডগুলি সার্ভার থেকে উপযুক্ত রেকর্ডটিও পুনরুদ্ধার করতে পারে । কর প্রদানের তথ্য মোবাইলের মাধ্যমে ইন্টারনেট থেকে যাচাইয়ের ব্যবস্থা করা গেলে এটিকে আরো বেশি জনবান্ধব ও বিশ্বাসযোগ্য করা সম্ভব ।
স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং: বাংলাদেশে অধিকাংশ চর্বণযোগ্য তামাকজাত দ্রব্যের কোন স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং ব্যবস্থা নেই। বিড়িসহ এমন অনেক চর্বণযোগ্য তামাকজাত দ্রব্যের মোড়ক/প্যাকেট রয়েছে যার মধ্যে স্ট্যাম্প/ব্যান্ডরোল ব্যবহার করা সম্ভব হয়না যার ফলে সরকার বড় অংকের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে । ভোক্তা অধিকার আইন ২০০৯ এর ধারা ৩৭ অনুযায়ী প্রত্যেকটি পণ্যের মোড়কে পণ্যটি তৈরীতে ব্যবহৃত উপাদান, সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য, পণ্যের ওজন, পরিমাণ, ব্যবহার বিধি উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক । কিন্তু এসব নিয়মের তোয়াক্কা না করেই প্রত্যেকটি ব্র্যান্ডের তামাকজাত দ্রব্যে’র (সিগারেট) প্যাকেটের গায়ে মুদ্রিত সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের থেকে স্থানভেদে ১০-২৫ টাকা অধিক মূল্যে বিক্রয় হয়। অথচ এই অতিরিক্ত অর্থ থেকে সরকারের কোনো প্রকার রাজস্ব আয় হচ্ছেনা।
সমগ্র বাংলাদেশের বাজার গবেষণা করে মোট ৩৮৭ টি ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানি ও ৭৮৮ টি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত পণ্যের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে । অথচ, এসব পণ্যের বাজারজাত করা কোম্পানিগুলোর অধিকাংশেরই কোনো প্রকার বৈধ নিবন্ধন নেই এবং পণ্যের ওজন মোড়কে মুদ্রিত ওজনের থেকে কম । এই সমস্যা সমাধানের জন্য স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন। যাতে করে, স্ট্যাম্প/ব্যান্ডরোল ব্যবহারের ব্যবস্থা নিশ্চিতের পাশাপাশি আইন অনুসারে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
ভ্যাট ব্যাবস্থা শক্তিশালীকরণে ডিজিটালইজেশনের প্রবর্তন : কর আদায়ের পদ্ধতি সহজ ও যুগোপযোগীকরণে বাংলাদেশ সরকার কর ব্যবস্থাপনাকে ডিজিটালাইজড করেছে । তামাক কর আদায়ে এখনও সেই আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। তামাকজাত দ্রব্যের কর আদায়ের ব্যান্ডরোল/ট্যাক্স স্ট্যাম্প ব্যবহারের ক্ষেত্রে শক্তিশালী বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকায় বিভিন্ন ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তন্মধ্যে, বিড়ি ও সিগারেটের ক্ষেত্রে এটি ব্যবহারের ভিন্নতা অন্যতম। এটির স্থাপন পদ্ধতি এবং যাচাই পদ্ধতি খুবই অস্পষ্ট যা খুব সহজেই নকল করা সম্ভব । ট্যাক্স মনিটরিং ব্যবস্থায় ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে করদাতার তথ্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে করের হার বাড়ানো, সাপ্লাই চেইন সম্বন্ধে সঠিক ধারণা পাওয়া, অতিরিক্ত রাজস্ব আয় বৃদ্ধিকরণ এবং ট্যাক্স আদায় প্রক্রিয়াটি আরো সহজতর করা সম্ভব হবে ।
বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদারকরণ: সমগ্র বাংলাদেশে যত্রতত্র তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়কেন্দ্র বিদ্যমান যার অধিকাংশই লাইসেন্সবিহীন । তাছাড়া, তামাকজাত দ্রব্যের সকল প্রচার প্রচারণা নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও এসকল বিক্রয়কেন্দ্রে প্রদর্শিত হচ্ছে বিভিন্ন চটকদার বিজ্ঞাপন । তামাক নিয়ন্ত্রণ এবং সঠিক কর আদায় নিশ্চিত করতে স্থানীয় সরকার কর্তৃক প্রস্তুতকৃত ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা’ অনুযায়ী প্রত্যেকটি তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়কেন্দ্রকে লাইসেন্সিংয়ের আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার । বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী অপ্রাপ্তবয়স্ক অর্থাৎ ১৮ বছরের কম বয়সীদের কাছে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করা আইনত দণ্ডনীয় । অথচ বিক্রেতারা এই আইনের তোয়াক্কা না করে অপ্রাপ্তবয়স্কদের কাছে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করছে ।
মনিটরিংয়ের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়াবলী যেমন- লাইসেন্সিং ব্যাবস্থা, নির্দিষ্ট প্যাকেজিং সিস্টেম, নকল পণ্য যাচাই ইত্যাদি বাধ্যতামূলক করা দরকার। এছাড়া, চর্বণযোগ্য তামাকের জন্য পৃথক মনিটরিং ব্যবস্থা জরুরি। কারন, অসংখ্য তামাক কোম্পানি কোনো প্রকার নিবন্ধন ছাড়াই ক্ষুদ্র এবং অসংগঠিতভাবে ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত পণ্যের উৎপাদন করছে। এ সকল কারখানার ঠিকানা খুঁজে বের করা কঠিন। এগুলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে যাচাই করা গেলে একদিকে যেমন বাজারে নকল সিগারেটের আধিক্য হ্রাস পাবে তেমনি সরকারের সঠিক রাজস্ব আদায় সম্ভবপর হবে।
তামাক কর ফাঁকি রোধে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে গিয়ে কোম্পানির হস্তক্ষেপের পাশাপাশি আরও কিছু বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সমস্যা সমাধানে নিম্নে কয়েকটি সুপারিশ উল্লেখ করা হলো:
- বারকোডসহ ট্যাক্স ব্যান্ডরোল ব্যবস্থা প্রবর্তন করা।
- তামাকজাত পণ্যের অবৈধ বাণিজ্য নিরসনে উদ্যোগ গ্রহণ করা।
- তামাকজাত দ্রব্যের ব্যান্ডরোল মনিটরিংয়ে ডিজিটালাইজেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
- সুনির্দিষ্ট কর আরোপের বিধান নিশ্চিত করা।
- তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য নিবন্ধন পোর্টাল তৈরি করা।
- সকল তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা।
- নিবন্ধনের ক্ষেত্রে মালিকের নাম, ভোটার আইডি, কোম্পানির নাম, ঠিকানা, লোগো, ট্রেডমার্ক, ভ্যাট নম্বর নিশ্চিত করা।
- স্থানীয় সরকারের সাথে সমন্বয় করে নিবন্ধিত তামাকজাত দ্রব্যের পাইকারী দোকানের তালিকা তৈরিকরণ।
- জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সাথে সমন্বয় করে চর্বণযোগ্য তামাকের স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং বাধ্যতামূলক করা।
- চর্বণযোগ্য তামাকের ক্ষেত্রে নিবন্ধনের নির্দিষ্ট সময় পর তামাকজাত দ্রব্যের পাইকারী দোকানগুলো পরির্দশন করা এবং নিবন্ধনবিহীন সকল তামাকজাত পণ্য ধ্বংস ও বাজেয়াপ্ত করা।
- জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ।
- নিয়মিত তামাকের বাজার পর্যবেক্ষণ এবং তামাক বিরোধী সংগঠনগুলোকে এই মনিটরিং কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা।
এসডিজি লক্ষ্য-৩ পূরণ করতে এবং সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুসারে জনগণের স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা রক্ষায় দাম বাড়ানোর পাশাপাশি তামাকজাত দ্রব্যের উপর করের বোঝা বৃদ্ধিকরণ, কর ফাঁকির হার হ্রাস করার জন্য খুবই প্রয়োজন। তামাক নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন প্রচলিত পন্থার পাশাপাশি রাজস্ব ফাঁকি রোধ এবং সর্বোপরি এই খাত থেকে বর্তমানে প্রাপ্ত রাজস্ব বৃদ্ধি করতে ডিজিটালাইজেশনের বিকল্প নেই। পরিশেষে বলা যেতে পারে যে, ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কর ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার হবে একটি মাইলফলক।
গবেষণা ও বিশ্লেষণ:
- মিঠুন বৈদ্য, প্রকল্প কর্মকর্তা, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট
- এডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম, কারিগরি উপদেষ্টা, দি ইউনিয়ন
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: - ব্যুরো অফ ইকোনমিক রিসার্চ (বিইআর)
- টোব্যাকো কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ সেল (টিসিআরসি)
- অধ্যাপক নাসির উদ্দিন আহমেদ (সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড)
- ফরিদা আখতার (নির্বাহী পরিচালক, উবিনীগ)
- সুশান্ত সিনহা (মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, তামাক নিয়ন্ত্রণ গবেষক)
To download the publication please click the download button.
Methun Baidya and Syed Mahbubul Alam