This research title is ‘Neglected vegetables, upward tobacco exports’. Ibrahim Khalil, Project officer of Bangladesh Network for Tobacco Tax Policy (BNTTP) completed the research. To download this full research in Bengali please click the download button.
অবহেলায় সবজি, উর্ধ্বমুখী তামাক রপ্তানি
তামাকপাতা এমন একটি পণ্য যার সবটুকু ক্ষতিকর। তারপরও বাংলাদেশে তামাক চাষী ও তামাক কোম্পানিকে স্বজ্ঞানে, সুস্থ্য মস্তিষ্কে বিগত সব প্রশাসন প্রত্যক্ষ/পরোক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে। তামাক চাষের ক্ষেত্রে বর্গাচাষীরা তামাক কোম্পানি থেকে ইচ্ছামতো ঋণ সুবিধা পেলেও সবজিসহ অধিকাংশ ফসল চাষীদের ক্ষেত্রে সে ব্যবস্থা নেই। বরং তারা তামাক চাষীদের ঋণ সুবিধা দিতে উন্মুখ হয়ে থাকে। ফলে ব্যাংক ঋণ নিয়ে অন্য ফসল চাষ করার চেয়ে তামাক কোম্পানির থেকে সহজলভ্য ঋণ গ্রহণ করে অনেক কৃষকই তামাক চাষে উদ্ধুদ্ধ হয়ে উঠছে। অন্যদিকে দেশে তামাক চাষের জমি কমে আসছে বলে তামাক কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়ত প্রচার করে আসলেও তা বাস্তবতার সঙ্গে মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
আবার ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনে তামাকের বিকল্প ফসল উৎপাদনে সহযোগিতার কথা বলা হলেও বাস্তবে এটারও তেমন কোনো প্রতিফলন নেই। বরং পার্বত্য চট্টগ্রামে শত শত আদিবাসী বংশ পরম্পরা যেখানে জুম চাষ করেছে বর্তমানে সেখানে তামাক চাষের প্রসারের কারণে সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রমেই সেখানে প্রকট হয়ে উঠছে খাদ্য সংকট। একইসঙ্গে নাটোর, রাজশাহী, পঞ্চগড়, রংপুর, কুষ্টিয়াসহ অধিকাংশ জেলাতেই উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে তামাক চাষ।
বাংলাদেশকে তামাক মুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্যে সরকার করার ঘোষণা দিলেও গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে তামাকজাত পণ্য রপ্তানিতে আরোপিত ২৫ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়। একইসঙ্গে অপ্রক্রিয়াজাত তামাকে থাকা ১০ শতাংশ রপ্তানি শুল্কও প্রত্যাহার করে শূন্য শতাংশ করা হয়েছে। যার পিছনে প্রধান উদ্দেশ্য তামাক চাষ ও রপ্তানিতে সরাসরি উৎসাহ দেওয়া। তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো সরকারের এহেন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করলেও তাতে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী দেশে বর্তমানে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৮৫ দশমিক ৭৭ লক্ষ হেক্টর। এর মধ্যে ৯৩ হাজার ৯৯৮ একর জমিতে তামাক উৎপাদন হয়। এর বিপরীতে সবজি চাষ হয় ১১ লাখ ১১ হাজার ৭৯৩ একর জমিতে! অথচ সমস্ত পৃষ্ঠপোষকতা যেনো তামাকেই। তামাক পণ্য রপ্তানিতে শূন্য শতাংশ শুল্কারোপের যে উদারতা দেখানো হয়েছে তাতে তামাক চাষকে আরো উৎসাহিত করার পাশাপাশি দেশে খাদ্যশষ্য উৎপাদনযোগ্য জমির পরিমান হ্রাস পাবে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি (বিএনটিটিপি) এর আওয়ায় সেকেন্ডারি তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি গবেষণা প্রকাশ হয়েছে। ‘তামাক ও অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য (সবজি) রপ্তানির তুলনামূলক পর্যালোচনা’ শীর্ষক এ গবেষণায় রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ গবেষণায় সবজির বিপরীতে তামাকের ক্ষেত্রে কেবল অপক্রিয়াজাত তামাক পাতা রপ্তানির তথ্য নেয়া হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট সবজি রপ্তানি হয়েছে ১৮৫২ কোটি ৩২ লাখ ৫ হাজার ৩০০ টাকার। এর বিপরীতে অপ্রক্রিয়াজাত বা তামাক পাতা রপ্তানি হয়েছে মোট ৩৮৯ কোটি ৭১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সবজি রপ্তানি থেকে আয়কৃত অর্থের পরিমান ১৪৭৬ কোটি ৭২ লাখ ৪৩ হাজার ৬২০ টাকা এবং তামাক রপ্তানি হয়েছে ৩২৪ কোটি ৮ লাখ ২ হাজার ৬৩০ টাকার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সবজি রপ্তানি হয়েছে মোট ১৫৭৭ কোটি ৫৬ লাখ ২৩ হাজার ১২৪ টাকার। আর তামাক পাতা থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ৪২৫ কোটি ৯৬ লাখ ২৫ হাজার ১৫২ টাকা।
অন্যদিকে ২০১৮-১৯ সালে যেখানে সবজি রপ্তানি হয়েছে ১৯২০ কোটি ৯২ লাখ ১৯ হাজার ২০৬ টাকার; সেখানে তামাক পাতা রপ্তানি হয়েছে ৪৯০ কোটি ২৬ লাখ ৭২ হাজার ৭২ টাকার। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে গত জানুয়ারি মাস পর্যন্ত মাত্র সাত মাসেই সবজি রপ্তানি হয়েছে ১৫৪৮ কোটি ৮০ লাখ ২৬ হাজার ২৩৬ টাকার। যা বিগত বছরের মধ্যে একই সময়ের মধ্যে রেকর্ড। একইসঙ্গে মাত্র সাত মাসে তামাক পাতা রপ্তানি হয়েছে ৪৫৫ কোটি ৫৩ লাখ ৬০ হাজার ১৯২ টাকার! যা ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরকে ইতোমধ্যেই ছাড়িয়ে গেছে এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরের আয়কৃত অর্থের চেয়ে মাত্র ৩৫ কোটি টাকা কম।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকার ও তামাক কোম্পানিগুলো যেখানে দাবি করে আসছে দেশে তামাক চাষ কমছে সেখানে সর্বশেষ অর্থবছরে বিগত চার বছরের রপ্তানি আয়কে তামাক কীভাবে ছাড়িয়ে যায়? সবজি চাষের জমি যেহেতু তামাক চাষের জমির চেয়ে প্রায় ১১ গুণ বেশি ফলে সবজি চাষ বৃদ্ধি এবং রপ্তানি বেশি হওয়া মোটেই অমূলক নয়। কিন্তু তামাক পাতায় রপ্তানি আয় বৃদ্ধির পিছনে সরকারের তামাক পণ্যে রপ্তানি শুল্ক শূন্যতে নামিয়ে আনার ফসল বলেই উপস্থাপিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে।
অথচ সরকার যদি চারস্তরের কর পদ্ধতি কমিয়ে দুই স্তরে নিয়ে আসে তাহলে যে পরিমাণ অর্থ তামাক রপ্তানি করে আয় হচ্ছে তার চেয়ে বেশি অর্থ রাজস্ব আয় করা সম্ভব। সঙ্গে ধূমপায়ীর সংখ্যাও কমিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু আদৌতে সরকারের প্রবল ইচ্ছা এবং তামাক কোম্পানির প্রভাবে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। বরং ব্রিটিশ অ্যামেরিকান ট্যোবাকো কোম্পানিতে সরকারের অংশীদারিত্বের কারণে রাষ্ট্রীয়ভাবেই তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে অনীহা দৃশ্যমান।
তবে সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, সরকার ও তামাক কোম্পানিগুলো দেশে তামাক চাষ কমে আসছে বলে যে দাবি করছে সেটাতেও সন্দেহ করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। কারণ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কৃষি বিষয়ে যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে তাতে ২০১৭-১৮ সালে মোট তামাক চাষ ১ লাখ ৪ হাজার ৯১৪ একর জমিতে হয়েছে বলে জানিয়েছে। যা ১০১৬-২০১৭ অর্থবছর থেকে ৮৩৮৩ একর কম। অথচ তামাক উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যবধান মাত্র ২৫৬৩ মেট্রিক টন। যা প্রতি একরের ফলন হিসেব করলে দাঁড়ায় শূন্য দশমিক ৩১ মেট্রিক টন। অথচ ওই অর্থবছরে প্রতি একরে তামাকের চাষ হয়েছে শূন্য দশমিক ৮৪ মেট্রিক টন! এভাবে প্রতি অর্থবছরের হিসেবেই নানা প্রশ্নের উদয় করা হয়েছে। ফলে এটা যে স্পষ্টতই তথ্য লুকিয়ের রাখারই একটি প্রক্রিয়া তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এছাড়া প্রকাশিত পরিসংখ্যানে এতোদিন ধরে জাতি, মতিহারি, ভার্জিনিয়া তামাক ছাড়াও ‘অন্যান্য’ ক্যাটাগরিতে দেশে ভিন্ন জাতের তামাক চাষ হয় বলেও প্রকাশ করে আসছে পরিসংখ্যান ব্যুরো। এর মধ্যে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪০৮ একর জমিতে চাষ হয়েছে ৩১৬ মেট্রিক টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩৭০ একর জমিতে ২৮৩ মেট্রিক টন। কিন্তু ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে এ ‘অন্যান্য’ জাতের তামাক উৎপাদনের কোনো রেকর্ড দেয়নি সরকারি এ প্রতিষ্ঠান। কোনো একটি জাতের তামাক দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদন হয়ে আসলেও হঠাৎ করেই তা এক বছরে শূন্যে চলে আসাটা অস্বাভাবিকই বটে। ফলে আসলেই এ জাতের তামাক বাংলাদেশে উৎপাদন হওয়া বন্ধ হয়ে গেছে নাকি তামাক উৎপাদন কম দেখানোটা সরকার ও কোম্পানিরই যৌথ পরিকল্পনার ফল সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। একইসঙ্গে সরকার তামাক ও সবজি রপ্তানিতে কেনো তামাককেই বেশি পৃষ্ঠপোষকতা করছে সেটাও প্রশ্নের সম্মুখীন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন, সেটা তিনি বাস্তবায়ন করবেন বলেই আশাবাদী তামাক বিরোধী বিভিন্ন সংগঠন। তবে সরকার এখনো দেশকে তামাক মুক্ত করণে যথেষ্ট আন্তরিক নয় বলেই প্রতীয়মান। কারণ তামাক রপ্তানিতে শূন্য শতাংশ শুল্কারোপ পদ্ধতি বাতিল করণ, তামাক কর প্রক্রিয়ায় চার স্তরের কর পদ্ধতি বাতিল এবং ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো কোম্পানি থেকে সরকারের শেয়ার বাতিল না হলে এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। ফলে সরকার যে মানুষের জীবন ও দেশকে বাঁচাতে যথেষ্ট আন্তরিক সেটা বাজেটে তার প্রতিফলন দেখাতে হবে।
এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করলে সরকারের একদিকে যেমন বিপুল অঙ্কের রাজস্ব আসবে, অন্যদিকে খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশে হুমকি কমার পাশাপাশি সরকারের লক্ষ্যও অর্জন হবে। সরকার ইতোমধ্যে জর্দা-গুলের মত মারাত্মক ক্ষতিকর ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের ট্যারিফ ভ্যালু প্রথা বিলুপ্ত করে খুচরা মূল্যের উপর যে করারোপ পদ্ধতি প্রচলন করেছে সেটা সত্যিই প্রশংসনীয়। তবে সামগ্রিকভাবে লক্ষ্যে পৌঁছাতে এখনো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।
ইব্রাহীম খলিল, প্রকল্প কর্মকর্তা, বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি (বিএনটিটিপি)।
To read the full report, please click the download button.