আদিবা কারিন

জনস্বাস্থ্যের ওপর তামাকজাত দ্রব্যের নেতিবাচক প্রভাব আমাদের সবার জানা। তাই বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়। তামাক নিয়ন্ত্রণের একটি অন্যতম কার্যকর পদ্ধতি হলো তামাকজাত দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে এবং এর ওপর উচ্চ হারে করারোপ করে এই ক্ষতিকর পণ্যটিকে সাধারণ মানুষের ক্রয় সামর্থের বাইরে নেয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনে (Framework Convention on Tobacco Control-FCTC) এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে।

কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, বাংলাদেশে বিড়ি-সিগারেটের মূল্য তুলনামূলকভাবে অবশ্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর চেয়েও সস্তা। অর্থনৈতিক সামর্থ বিবেচনায় এটি সব পর্যায়ের মানুষের কাছেই সহজলভ্য। মানুষের মাথাপিছু আয় নিয়মিত হারে বাড়ছে, সেই সাথে বাড়ছে মানুষের ক্রয় সামর্থ। বাংলাদেশে খাদ্য সামগ্রীর দাম ক্খনো নিম্ন আয়ের মানুষের সামর্থের বাইরে গেলেও তামাক সামগ্রীর দাম

মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যেই থেকেছে সবসময়। তার ফল স্বরুপ নিম্ন-মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের সিগারেটের বাজার সারা পৃথিবীর মধ্যে অষ্টম বৃহত্তম।

এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষেতে বিগত ১০ বছরে বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী ও সিগারেটের দাম বৃদ্ধির তুলনামূলক চিত্র খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়েছে।

এই গবেষণার জন্য বাংলাদেশের অবশ্যক খাদ্য উপাদান চাল (১ কেজি বিআর-১১, বিআর-৮ চাল) এবং সাধারণ মানুষের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর সহজ উপাদান ফার্মের মুরগির ডিমের (১ হালি লাল ডিম) দাম নেয়া হয়েছে। যা থেকে সাধারণ মানুষের নিত্যব্যবহার্য খাদ্যদ্রব্যের দামের একটি ধারণা পাওয়া যায়। ২০০৮ থেকে ২০১৮ – এই ১০ বছরের তথ্যগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ক্যাব) এর বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে।

অন্যদিকে, সিগারেটের দামের জন্য বেছে নেয়া হয়েছে ক্যাপস্ট্যান সিগারেটের ১০ শলাকার প্যাকেট। যার ১০ বছরের দামগুলো নেয়া হয়েছে স্ট্যাটিস্টিকাল ইয়ারবুক অফ বাংলাদেশ থেকে। তথ্যগুলো একত্রিত করে প্রতি বছর এই তিনটি পণ্যের দামের শতাংশ হারে যে পরিবর্তন- সেগুলোর মধ্যে তুলনা করা হয়েছে। এই গবেষণাটি সেকেন্ডারি তথ্যের ভিত্তিতে হওয়ায় বাজার থেকে সিগারেটের খুচরা মূল্য জানা সম্ভব হয়নি, এর পরিবর্তে নিম্ন স্তরের একটি সিগারেটের (ক্যাপস্ট্যান) দাম নেয়া হয়েছে।

১০ বছরের দামের তুলনামূলক বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, অন্যান্য নিত্যব্যবহার্য পুষ্টিকর পণ্য যেমন চাল ও ডিমের তুলনায় প্রতি বছর প্রাণঘাতী সিগারেটের দাম বেড়েছে খুবই সামান্য। ক্যাব ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০০৮ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত প্রতিটি পণ্যের দামই নির্দিষ্ট হারে বেড়েছে। কিন্তু তারপরও সিগারেটের দাম বেড়েছে অন্য পণ্যগুলোর তুলনায় খুবই কম হারে, ফলে যে কোনো বয়সের এবং শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে সিগারেট আরো সহজলভ্য হয়েছে।

পরিসংখ্যানের ভাষায় বলা যায়, ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালে চালের দাম বেড়েছে শতকরা ২৪% হারে, যেখানে সিগারেটের দাম বেড়েছে মাত্র ১০% হারে।

১ স্টিক সিগারেট, ১ কেজি চাল ও ১টি ডিমের দামের তুলনা করলে দেখা যায়, বিগত বছরগুলোতে সিগারেটের দাম বৃদ্ধির হার সবসময়ই ছিল চাল ও ডিমের দামের চেয়ে বেশ কম । বাজারে এক স্টিক সিগারেট একটি ডিমের চেয়েও সহজলভ্য হওয়ায় এবং প্যাকেট খুলে শলাকা হিসাবে (Lose selling) বিক্রির বিষয়ে কোনো বিধিনিষেধ না থাকায়, প্রান্তিক জনগোষ্ঠির মানুষ, এমনকি অপ্রাপ্তবয়স্করাও নামমাত্র দামে যেকোনো জায়গা থেকে সিগারেট কিনতে পারছে। সাশ্রয়ী ও পুষ্টিকর খাদ্যের বদলে ক্ষতিকর তামাকপণ্য বেছে নেয়ার এই প্রবণতা শুধু অর্থনীতিই নয়, এর

পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যের জন্যেও ভীষণ ঝুঁকি বয়ে আনছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সিগারেট বাজারে সহজে পাওয়া যাওয়ার ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে এবং এর ফলে নারী ও শিশুরা অনিচ্ছাকৃত, পরোক্ষ ধূমপানের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। প্রতিনিয়তই এ বিষয়গুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোবাকো কন্ট্রোল নামক চুক্তির অবমাননা করে চলেছে।

দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে তামাক পণ্যকে সাধারণ মানুষের সামর্থের বাইরে নেয়া তামাক নিয়ন্ত্রণের একটি অন্যতম কার্যকর কৌশল। তবে এই বৃদ্ধি এমনভাবে হতে হবে যেনো তা মুদ্রাস্ফীতির সাথে সাথে মানুষের ক্রয় সামর্থ বৃদ্ধির হারের চাইতে বেশি হয়। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সাথে সমানতালে বা তার চেয়ে কম  হারে তামাকজাত দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি তামাক নিয়ন্ত্রণে কোনো অবদানই রাখে না বরং এই জনস্বাস্থ্য হানিকর পণ্যটিকে মানুষের কাছে আরো সহজলভ্য করে তোলে। প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সাপেক্ষে তামাকজাত দ্রব্যের দাম বৃদ্ধির হার যখন কম হয় তখন সাদা চোখে আমরা দ্রব্যটির দাম বাড়তে দেখলেও প্রকৃত পক্ষে এটির দাম আরো কমে যায়।

নিম্নোক্ত সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে সিগারেটের দাম আমরা সাধারণ মানুষের ক্রয় সীমার বাইরে নিতে পারি যাতে তামাক সেবনকারী এর ব্যবহার কমিয়ে দেয় বা ছেড়ে দেয় এবং নতুন করে কেউ তামাক ব্যবহারে নিরুৎসাহী হয়।

১) বর্তমানে প্রচলিত বহুস্তর বিশিষ্ট সম্পূরক শুক্ল (ad valorem tax) নির্ভর কর পদ্ধতির পরিবর্তনের মাধ্যমে করারোপ পদ্ধতি আরো সহজতর করা

২) বর্তমানে প্রচলিত সম্পূরক শুক্ল (ad valorem tax) এর পাশাপশি সুনির্দিষ্ট করারোপ পদ্ধতির প্রচলন

৩) তামাকজাত দ্রব্য থেকে রাজস্ব সংগ্রহ ও কর প্রশাসন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং তামাক ব্যবহার কমিয়ে আনার গুরুত্ব সম্পর্কে সংবেদনশীল করে তোলা

৪) তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ রুখতে সর্বান্তকরণে সচেষ্ট হতে হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। আমরা সবাই সম্মিলিতভাবে কাজ করলে এই লক্ষ্যে অর্জনে সমর্থ হবো।

 

17 March, 2020