দক্ষিণ এশীয় স্পীকারদের শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ভাষণ -

দক্ষিণ এশীয় স্পীকারদের শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ভাষণ

দক্ষিণ এশীয় স্পীকারদের শীর্ষ সম্মেলন

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জন সমাপন অনুষ্ঠান

ভাষণ

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী

শেখ হাসিনা

প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেল, ঢাকা, রবিবার, ১৮ মাঘ ১৪২২, ৩১ জানুয়ারি ২০১৬


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

 

আইপিইউ-এর সম্মানিত সভাপতি জনাব সাবের হোসেন চৌধুরী,

শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টের ডেপুটি স্পীকার থিলাঙ্গা সুমাথিপলা,

আফগানিস্তানের ওলেসি জিগরার স্পীকার আব্দুল রউফ ইব্রাহিম,

ভুটানের জাতীয় সংসদ সংগুর স্পীকার জিগমে জাংপো,

মালদ্বীপের মজলিসের স্পীকার আব্দুল্লাহ মাসেহ মোহামেদ,

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের স্পীকার ড . শিরীন শারমিন চৌধুরি,

ভারতের লোকসভার স্পীকার শ্রীমতি সুমিত্রা মহাজন,

ও উপস্থিত সুধিবৃন্দ।

আসসালামু আলাইকুম এবং শুভ অপরাহ্ন।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য-এসডিজি অর্জনের উপর দক্ষিণ এশিয়ার স্পীকারদের প্রথম শীর্ষ সম্মেলনের সমাপন অনুষ্ঠানে সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। এই সম্মেলন আয়োজনের জন্য প্রথমেই আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নকে (আইপিইউ)। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ এই সম্মেলনের আয়োজক এবং Campaign for Tobacco-Free Kids কারিগরি সহযোগিতা প্রদান করছে। আমি উভয় সংস্থাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনের উপর দক্ষিণ এশীয় স্পীকারদের প্রথম শীর্ষ সম্মেলন শেষে ‘ঢাকা ঘোষণা’। গ্রহণ করার জন্য আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। অংশগ্রহণকারী স্পীকারবৃন্দ যে ঘোষণা এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আমি ব্যক্তিগতভাবে এবং আমার সরকারের পক্ষ থেকে সেগুলোর প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা, অংশীদারিত্ব, সুশাসন, অন্তর্ভুক্তি, অংশগ্রহণ, অধিকার এবং নিরাপত্তা বিষয়ে আপনারা যেসব বিষয়ের উপর গুরুত্বরাপ করেছেন আমি সেগুলোর প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি।

সম্মানিত স্পীকারবৃন্দ এবং সুধিবৃন্দ,

আপনারা জানেন সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। আমরা অতি-দারিদ্রের হার অর্ধেকে নামিয়ে এনেছি। শহর এবং গ্রামীণ উভয় অঞ্চলেই আমরা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পানি সরবরাহ এবং পয়ঃসেবার মত মৌলিক বিষয়ে অধিকতর সুবিধা নিশ্চিত করেছি। বিশ্বমন্দা সত্বেও গত ৭ বছর ধরে আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের উপর ছিল। গত এক দশকে আমাদের রপ্তানি আয় ৩ গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে প্রায় ৮ গুণেরও কাছাকাছি। বিশ্বব্যাংকের মান অনুযায়ী গতবছর বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। আমরা এখন ২০২১ সালে মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।

আমরা জাতিসংঘের উচ্চাভিলাষী ২০৩০ এজেন্ডা গ্রহণ করেছি। বাংলাদেশে আমরা এমডিজি বাস্তবায়নের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং এমডিজি’র সাফল্যের উপর ভর করে এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। এজন্য দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক বৈশ্বিক অংশীদারিত্বের প্রয়োজন।

আমি মনে করি ২০৩০ এজেন্ডা হচ্ছে একটি সম্মিলিত পথ-পরিক্রমা। এর বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সরকারি এবং বেসরকারি, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক, সকল উৎস থেকে অধিক পরিমাণে সম্পদের সরবরাহ প্রয়োজন। সুতরাং শুরু থেকেই বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তা বা ওডিএ-এর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

গণতন্ত্রের প্রধান প্রতিষ্ঠান হিসেবে এসডিজি বাস্তবায়নে পার্লামেন্টের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে এসডিজি লক্ষ্যকে সমন্বিতভাবে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এবং এর কার্যক্রম মনিটর করার জন্য বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নিতে হবে। বিভিন্ন স্টোকহোল্ডার যেমন নারী-পুরুষ, নাগরিক সমাজ, কম্যুনিটি এবং ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, যুবসমাজ ইত্যাদির সঙ্গে অংশীদারিত্ব, আলোচনা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য আমি দক্ষিণ এশিয়ার পার্লামেন্টগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি গড়ে তোলার উপর জোর দিতে চাই।

এসডিজি’র পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য আমি সম্মানিত স্পীকার এবং সংসদ সদস্যদের প্রয়োজনীয় বাজেট অনুমোদনের উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।

সুধিবৃন্দ,

উন্নয়ন এবং সুস্বাস্থ্যের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বিদ্যমান। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি তামাক-জনিত রোগ-বালাই এবং অসংক্রামক রোগের অব্যাহত প্রকোপ হ্রাসে এ অঞ্চলের এবং এর বাইরের সংসদকে এসডিজি-৩-তে বর্ণিত সুস্থ জীবনযাপন নিশ্চিত করতে তাদের আরও তৎপর হতে হবে। এসব রোগের ব্যাপকতা আমাদের দেশে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তামাক নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত কনভেনশন এফসিটিসির (FCTC) বাস্তবায়ন। এসডিজির ১৭টি উদ্দেশ্য এবং ১৬৯টি লক্ষ্য পূরণই হবে আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য পূর্বশর্ত।

আমি মনে করি FCTC বাস্তবায়ন বিশেষভাবে ২টি সুনির্দিষ্ট কারণে অপরিহার্য। প্রথমতঃ FCTC ছাড়া এসডিজি’র তৃতীয় উদ্দেশ্য সুস্থ জীবনযাপন এবং সব বয়সের মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়তঃ অন্যান্য এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে তামাক একটি বড় বাধা।

বর্তমানে তামাকের ব্যবহার মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যেমন বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান, মিয়ানমার এবং শ্রীলঙ্কায় তামাক-গ্রহণকারীর মোট সংখ্যা প্রায় ৩৮৩ মিলিয়ন। এটা বিশ্বের মোট ১.১ বিলিয়ন তামাকগ্রহণকারীর সংখ্যার ৩৪.৮% অর্থাৎ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।

এসব দেশে তামাকজনিত আর্থিক এবং স্বাস্থ্যগত ক্ষতির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। শুধু ভারত এবং বাংলাদেশে তামাকগ্রহণ-জনিত কারণে প্রতিবছর কমপক্ষে ১.১ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়।

আমার সরকার জনস্বাস্থ্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। FCTC বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে আমরা ২০১৩ সালে ধুমপান এবং তামাক জাতীয় পণ্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন সংশোধন করেছি এবং ২০১৫ সালে সংশ্লিষ্ট বিধি পাশ করেছি।

এই আইন প্রয়োগের মাধ্যমে কীভাবে অধিকতর সুফল পাওয়া যায়, বর্তমানে আমরা তার প্রতি দৃষ্টি দিয়েছি। ২০১৩ সালের তামাক জাতীয় পণ্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন এবং ২০১৫ সালের বিধি অনুসরণ করে আগামী মার্চ থেকে আমরা তামাকজাত পণ্যের মোড়কে ছবিসম্বলিত সতর্কবার্তা সংযোজন করতে যাচ্ছি। আমাদের প্রতিবেশি ভারত, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কায় এটা ইতোমধ্যে চালু করা হয়েছে।

জনস্বাস্থ্য রক্ষা এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মকান্ডকে উৎসাহ দিতে আমরা ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে তামাকের উপর ১ শতাংশ হারে সারচার্জ আরোপ করেছি। বাংলাদেশে এটাই এ ধরণের প্রথম পদক্ষেপ। তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মকান্ড সমন্বিতভাবে পরিচালনার জন্য আমার সরকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল গঠন করেছে।

জাতীয় পর্যায়ে প্রস্ততি হিসেবে আমাদের পরিকল্পনা কমিশন বৈশ্বিক এজেন্ডার সাথে মিল রেখে সম্প্রতি এম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে । এতে তামাক-সম্পর্কিত বিরূপ বিষয়গুলোর সুরাহা করা হয়েছে।

এসব ছাড়াও, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় দুটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন করছে। এগুলো হচ্ছে : তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রণয়ন। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে তামাক চাষ প্রসারের ব্যাপকতা হ্রাস এবং খাদ্য নিরাপত্তার হুমকি মোকাবিলা। অন্যটি হচ্ছে তামাকের চাহিদা এবং সরবরাহ হাসের জন্য একটি ব্যাপকভিত্তিক জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রণয়ন।

যদিও আমরা তামাক নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছি, কিন্তু আমরা এ নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগছি না। FCTC বাস্তবায়ন এবং বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাসের জন্য আমাদের আরও অনেক কিছু করতে হবে।

আমরা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাকের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করতে চাই। এই ঈপ্সিত লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য আমরা যে বিষয়গুলোর উপর গুরুত্বারোপ করছি সেগুলো হচ্ছে :

  • প্রথম পদক্ষেপে স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ব্যবহার করে একটি তহবিল গঠন করা-যা দিয়ে দেশব্যাপী জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে।
  • দ্বিতীয় ধাপে, আমরা তামাকের উপর বর্তমান শুল্ক-কাঠামো সহজ করে একটি শক্তিশালী তামাক শুল্ক-নীতি গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিব। এর উদ্দেশ্য হবে দেশে তামাকজাত পণ্যের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস এবং একইসাথে এ অঞ্চলের সর্বোত্তম ব্যবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকারের শুল্ক আয় বৃদ্ধি করা।
  • সর্বোপরি, আমার সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নের জন্য সব ধরণের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এসডিজি বাস্তবায়নের অগ্রাধিকারের সাথে মিল রেখে আমরা আমাদের আইনগুলোকে FCTC’র সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করব।

সুধিবৃন্দ,

আমরা ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের জ্ঞান-ভিত্তিক ডিজিটাল অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিণত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি। এরপর আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করা। এভাবেই আমরা আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চাই।

আমরা এমডিজি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্বকে যেমন তাক লাগিয়ে দিয়েছি, তেমনি এসডিজি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও আমরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।

আমাদের এই পথ-যাত্রায় আমরা সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি ন্যায়-ভিত্তিক, সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ প্রগতিশীল বাংলাদেশ গড়ে তুলব। আসুন আমরা আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্য আমাদের ইচ্ছাশক্তি এবং সম্পদকে নিবেদন করি।

এ অঞ্চলের দেশগুলোর স্পীকারবৃন্দের নেতৃত্বে এবং সংসদ সদস্যদের প্রাজ্ঞ পরামর্শে এসডিজি বাস্তবায়নে আমাদের পথচলা সুন্দর ও সফল হোক-এ প্রত্যাশা করে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।

আপনাদের সবাইকে আবারও আন্তরিক ধন্যবাদ।

 

খোদা হাফেজ

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু

বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

 

ভাষণটি ডাউনলোড করতে নিচের ডাউনলোড অপশনে ক্লিক করুন

২০১৬ সালে দক্ষিণ এশীয় স্পীকারদের শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ভাষণ